দেহলিজের পাতা | Pijush Biswas

পীযূষকান্তি বিশ্বাস , দেহলিজ পত্রিকার সম্পাদক ।


ভূমিকা:

পীযূষকান্তি বিশ্বাস । জন্ম ১৯৭৫ হাট বহিরগাছি, জেলা নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ , ভারত । পিতা জ্ঞানেন্দ্র নাথ বিশ্বাস ভাবগান গায়ক । মাতা, করুণাময়ী বিশ্বাস । কবি পীযূষকান্তি বিশ্বাস স্কুল জীবনে লেখালেখি করলেও সেই সমস্ত কাজ আজ সংগ্রহে নেই । ১৯৯২ সালে তিনি রাণাঘাট কলেজ থেকে ১২ ক্লাস পাশ করার পর ভারতীয় বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন । সেই সময়কার কিছু কবিতা বিভিন্ন ব্লগে পাওয়া যায় । ১৯৯৮ সালে তিনি দিল্লিতে পোস্টিং নিয়ে আসেন . এখান থেকে প্রকাশিত 'কথাঞ্জলী' পত্রিকার মাধ্যমে তার পরবর্তী জীবনের কবিতা যাপন শুরু হয় । ২০১৪ এ দিল্লি হাটার্সের সম্পাদক দিলীপ ফৌজদারের সহায়তায় তার প্রথম কবিতার বই, 'বাঁধা নয় রক্ত' । পরবর্তী গ্রন্থ 'ঘুমঘর' দিল্লির বইমেলায় প্রকাশিত হয় । ২০১৬ তে তার দ্বিতীয় কবিতা গ্রন্থটি 'আকাশ চুম্বন' নামে কলকাতার অভিযান পাবলিশার্স প্রকাশ করেন । কবিতা লেখা ছাড়া, পীযূষকান্তি বিশ্বাস বাংলা সাহিত্য পরিসরে, বিভিন্ন ব্লগে ও সোস্যাল মিডিয়ায় কবিতা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ লিখে থাকেন । এ ছাড়া, সম্পাদক হিসাবে তিনি সম্পাদনা করেছেন 'শূন্যকাল' ওয়েব ম্যাগাজিন । বর্তমানে দেহলিজের সম্পাদনা ও পরিচালনার দায়িত্বে আছে কবি পীযূষকান্তি বিশ্বাস ।

বাংলা সাহিত্যের বিশাল আকাশে প্রতিনিয়ত নতুন নক্ষত্রের উদয় হয়। কেউ আসেন ক্ষণিকের দ্যুতি ছড়িয়ে, কেউ বা স্থায়ী আসন লাভ করেন আপন প্রতিভার ঔজ্জ্বল্যে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জগতে, বিশেষ করে প্রবাসী বাঙালি সাহিত্যচর্চার পরিমণ্ডলে, পীযূষকান্তি বিশ্বাস এক স্বতন্ত্র ও পরিচিত নাম। তিনি একাধারে কবি, সমালোচক এবং সম্পাদক। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার মাটির গন্ধ গায়ে মেখে যাঁর শৈশব কেটেছে, কর্মজীবনের সূত্রে তিনি থিতু হয়েছেন ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লিতে। কিন্তু দূরত্ব তাঁর সাহিত্যসত্তাকে এতটুকু ম্লান করতে পারেনি, বরং নতুন পরিবেশ, নতুন অভিজ্ঞতা তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। নতুন দিল্লিতে বসবাসকালে তিনি কেবল নিজের সাহিত্যচর্চাই অব্যাহত রাখেননি, একইসাথে রাজধানীর বুকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রসারে, বিশেষ করে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে, এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। একদিকে তিনি যেমন একজন দক্ষ প্রযুক্তিবিদ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে ক্লাউড আর্কিটেক্ট হিসেবে কর্মরত এবং তিনটি আন্তর্জাতিক পেটেন্টের অধিকারী, অন্যদিকে তাঁর মন পড়ে থাকে বাংলা কবিতার শব্দে, ছন্দে, ভাবে। প্রযুক্তি ও কবিতার এই আপাত বিপরীতমুখী দুটি সত্তার সার্থক মেলবন্ধন ঘটেছে পীযূষকান্তি বিশ্বাসের জীবনে ও কর্মে। তাঁর সাহিত্যযাত্রা শুরু হয়েছিল নতুন দিল্লির মহাবীর এনক্লেভ অঞ্চল থেকে, যা পরবর্তীতে পল্লবিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বৃহত্তর পরিসরে। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত পত্রিকা, তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ এবং বিভিন্ন সাহিত্য সম্মেলনে তাঁর অংশগ্রহণ – এই সবকিছু মিলিয়ে পীযূষকান্তি বিশ্বাস প্রবাসী বাংলা সাহিত্যের জগতে এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা: প্রতাপগড়ের সবুজ প্রান্তর থেকে বহিরগাছির পথে

পীযূষকান্তি বিশ্বাসের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার এক অখ্যাত কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর গ্রাম প্রতাপগড়ে। তাঁর পিতার নাম জ্ঞানেন্দ্রনাথ বিশ্বাস এবং মাতার নাম করুণাময়ী বিশ্বাস। গ্রাম বাংলার চিরায়ত সবুজ, খোলা মাঠ, পুকুর আর দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেতের মধ্যেই তাঁর শৈশবের দিনগুলি কেটেছে। প্রতাপগড়ের নির্মল বাতাস আর অফুরন্ত খেলার মাঠ ছিল তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী। গ্রামের পোস্ট অফিস ছিল নিকটবর্তী হাট বহিরগাছিতে, যা তাঁর জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও মিশুকে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতিও ছিল তাঁর প্রবল আকর্ষণ। বিশেষ করে ক্রিকেটের প্রতি ছিল তাঁর অমোঘ টান। তিনি নিয়মিত বহিরগাছি ক্রিকেট দলের সদস্য হিসেবে খেলতেন এবং মাঝেমধ্যে পার্শ্ববর্তী বগুলা ক্রিকেট দলের হয়েও মাঠে নামতেন। গ্রামের সেই মুক্ত পরিবেশ, বন্ধুদের সাথে হইচই করে খেলাধুলার স্মৃতি তাঁর কবিমনে গভীর রেখাপাত করেছে, যা হয়তো তাঁর পরবর্তীকালের কবিতায় প্রকৃতির অনুষঙ্গ হিসেবে ফিরে ফিরে এসেছে। গ্রামের সহজ সরল জীবনযাত্রা, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, ঋতুচক্রের পরিবর্তন – এই সবকিছুই তাঁর সংবেদনশীল মনকে প্রভাবিত করেছিল। এই গ্রামীণ পটভূমিই তাঁর ভিত্তি নির্মাণ করে দিয়েছিল, যা পরবর্তীতে শহরের ইট-কাঠ-পাথরের জীবনে এসেও তাঁকে শিকড়ের টান অনুভব করিয়েছে।

শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবনের সূচনা: বহিরগাছি থেকে ব্যাঙ্গালোর

গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষার পর তিনি ভর্তি হন বহিরগাছি হাই স্কুলে। পড়াশোনায় তিনি বরাবরই মনোযোগী ছিলেন। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ১৯৯০ সালের জুন মাসে তিনি পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অধীনে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এই সময় থেকেই তাঁর মধ্যে বহির্জগতের প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ তৈরি হতে থাকে। বৃহত্তর পৃথিবীর হাতছানি তাঁকে টানতে শুরু করে।

মাধ্যমিক পাশের পর প্রথাগত উচ্চশিক্ষার পথে না হেঁটে তিনি নিজের কর্মজীবন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। মাত্র আঠারো বছর বয়সে, ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, তিনি এক নতুন জীবনের সন্ধানে পাড়ি জমান সুদূর ব্যাঙ্গালোরে। সেখানে তিনি ভারতীয় বায়ুসেনার অধীনে জলাহাল্লিতে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম অপারেটর (ADSO) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এটি ছিল তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। গ্রামের পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে সম্পূর্ণ এক নতুন জায়গায়, নতুন পেশায় নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ তিনি গ্রহণ করেন। বায়ুসেনার কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে তাঁর মধ্যে এক দৃঢ় মানসিকতা গড়ে ওঠে।

পরবর্তীকালে তিনি এয়ারম্যান হিসেবে জম্মু ও কাশ্মীরের তেইশ নম্বর উইং এয়ারফোর্স স্টেশনে নিযুক্ত হন। এই পোস্টিং তাঁর জীবনে এনে দেয় ভিন্ন অভিজ্ঞতা। একদিকে যেমন দেশের সুরক্ষার মতো এক গুরুদায়িত্ব পালনের সুযোগ, অন্যদিকে তেমনই ভিন্ন একটি রাজ্যের প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর মনোজগৎকে আরও প্রসারিত করে। বায়ুসেনায় তাঁর কাজটি ছিল মূলত প্রযুক্তিগত (টেকনিক্যাল ট্রেড)। তিনি এয়ার ডিফেন্স অপারেশনের সাথে যুক্ত প্রযুক্তিগত কর্মী হিসেবে কাজ করার পর কার্টোগ্রাফি বা মানচিত্রাঙ্কনের কাজে নিযুক্ত হন। কম্পিউটার বিষয়ে তাঁর সহজাত আগ্রহ ও দক্ষতা ছিল। এই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি বায়ুসেনার ইলেকট্রনিক ডেটা প্রসেসিং (EDP) সেলে কর্মরত থাকাকালীন বিভিন্ন সফটওয়্যার সিস্টেম ডেভেলপমেন্টের কাজ করেন, যা তাঁর প্রযুক্তিগত দক্ষতার পরিচায়ক।

দিল্লিতে আগমন, উচ্চশিক্ষা ও ব্যক্তিগত জীবনের নতুন অধ্যায়

১৯৯৮ সালের অক্টোবর মাস পীযূষকান্তি বিশ্বাসের জীবনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসে। তিনি বদলি হয়ে আসেন নতুন দিল্লির পালাম এয়ারফোর্স স্টেশনে। দেশের রাজধানীর বুকে তাঁর জীবনের নতুন পর্ব শুরু হয়। একদিকে বায়ুসেনার দায়িত্বপূর্ণ কাজ, অন্যদিকে দিল্লির কর্মব্যস্ত জীবন – এই দুইয়ের মাঝেও তিনি নিজের জ্ঞানার্জনের স্পৃহাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি (IGNOU) থেকে মাস্টার অফ কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনস (MCA) কোর্সে ভর্তি হন। প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে নিজের দক্ষতাকে আরও শাণিত করার লক্ষ্যে তাঁর এই প্রচেষ্টা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। বায়ুসেনার চাকরির পাশাপাশি দূরশিক্ষার মাধ্যমে এই উচ্চডিগ্রি অর্জন করা নিঃসন্দেহে কঠিন ছিল, কিন্তু তাঁর অধ্যবসায় ও নিষ্ঠা তাঁকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। ২০০৩ সালের জুন মাসে তিনি সফলভাবে এমসিএ ডিগ্রি লাভ করেন।

দিল্লিতে আসার পরই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ২০০০ সালের জুলাই মাসে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন বিউটি বিশ্বাসের সাথে। বিউটি বিশ্বাস নদীয়া জেলার বাগুলার বাসিন্দা রমেশ দত্তের কন্যা। এই বিবাহ তাঁর জীবনে নিয়ে আসে এক পূর্ণতা।

২০০৪ সালের জুন মাসে তাঁদের জীবনে আসে আরও এক আনন্দের মুহূর্ত। কোলকাতার কমান্ড হাসপাতালে তাঁদের পুত্রসন্তান ঋজুস্মিতের জন্ম হয়। সেই সময় পীযূষকান্তি বিশ্বাসের পোস্টিং ছিল রাজস্থানের জয়সলমীর এয়ারফোর্স স্টেশনে। পুত্রের জন্ম তাঁর পিতৃত্বের অনুভূতিকে পূর্ণতা দেয় এবং জীবনের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

কর্মস্থল পরিবর্তন হলেও দিল্লিই ধীরে ধীরে তাঁর স্থায়ী ঠিকানা হয়ে ওঠে। ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে তিনি সপরিবারে দিল্লির মহাবীর এনক্লেভ অঞ্চলে একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি এই অঞ্চলেরই বাঙালি কলোনিতে একটি নিজস্ব ফ্ল্যাট কেনেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। নতুন দিল্লিতে তাঁর এই থিতু হওয়া কেবল বাসস্থান পরিবর্তন ছিল না, এটি ছিল তাঁর সাহিত্য জীবনের উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়ার সূচনা।

সাহিত্য জগতে পদার্পণ: মহাবীর এনক্লেভ থেকে কথাঞ্জলীর আঙিনায়

দিল্লির মহাবীর এনক্লেভ অঞ্চলটি প্রবাসী বাঙালিদের একটি পরিচিত ঠিকানা। এখানে বসবাসকারী বাঙালি পরিবারগুলির মধ্যে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার একটি সুন্দর পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। পীযূষকান্তি বিশ্বাস এই পরিবেশের সাথে দ্রুত মিশে যান। বায়ুসেনার চাকরি এবং প্রযুক্তিগত পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁর মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা সৃজনশীল সত্তাটি এবার প্রকাশের পথ খুঁজে পায়।

২০০২ সালের মে মাস তাঁর সাহিত্য জীবনের এক মাইলফলক। এই সময়ে মহাবীর এনক্লেভ থেকে প্রকাশিত 'কথাঞ্জলী' নামক একটি বাংলা লিটল ম্যাগাজিনে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। এই প্রকাশ তাঁকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে। 'কথাঞ্জলী’ পত্রিকাটি ছিল সেই অঞ্চলের সাহিত্যপ্রেমী মানুষদের একটি মিলনক্ষেত্র। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন শ্রী দিলীপ কুমার ব্যানার্জী। পীযূষকান্তি বিশ্বাস কেবল লেখক হিসেবেই নয়, পত্রিকাটির প্রকাশনার সাথেও বিভিন্নভাবে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ২০০২ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ এক দশক ধরে ' কথাঞ্জলী 'র সাথে যুক্ত ছিলেন এবং পত্রিকাটিকে সচল রাখতে নানা ধরনের ভূমিকা পালন করেন। এই সময়ে তিনি নিয়মিত কবিতা লিখতে শুরু করেন এবং মহাবীর এনক্লেভের বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডায় (সাহিত্য বাসর) সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে থাকেন। এই সাহিত্যিক পরিমণ্ডল তাঁর কবি প্রতিভাকে বিকশিত হতে সাহায্য করে। দিলীপ কুমার ব্যানার্জীর মতো অভিজ্ঞ সম্পাদকের সান্নিধ্য ও উৎসাহ তাঁর সাহিত্য যাত্রাকে মসৃণ করে তোলে।

প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ ও সাহিত্যিক যোগাযোগের বিস্তার

দীর্ঘদিন ধরে কবিতা লেখার পর পীযূষকান্তি বিশ্বাস তাঁর লেখাগুলিকে গ্রন্থাকারে প্রকাশের কথা ভাবেন। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি তাঁর প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করেন। বইটির নাম ছিল 'বাধা নই রক্ত'। এটি কোনো প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়নি, বরং নিজের উদ্যোগেই কম্পিউটার প্রিন্ট-আউট ফর্মে এটি প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু এই আপাত অনাড়ম্বর প্রকাশের মধ্যেও একটি বিশেষ প্রাপ্তি ছিল। বইটির ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন ' কথাঞ্জলী ' পত্রিকার সম্পাদক, তাঁর সাহিত্য জীবনের প্রথম দিকের পথপ্রদর্শক, দিলীপ কুমার ব্যানার্জী। এটি ছিল তরুণ কবি পীযূষকান্তির জন্য এক বিরাট সম্মান ও স্বীকৃতি। এই বইটি তাঁর আত্মবিশ্বাসকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।

এরপর দিল্লির বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁর পরিচিতি আরও বাড়তে থাকে। ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি 'দিল্লী হাটার্স' নামে একটি সাহিত্য গোষ্ঠীর সাথে পরিচিত হন। এই পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন দীপঙ্কর দত্ত এবং দিলীপ ফৌজদার। 'দিল্লী হাটার্স ' ছিল দিল্লির তরুণ ও প্রতিষ্ঠিত বাঙালি লেখক-কবিদের একটি প্রাণবন্ত আড্ডা ও বিনিময়ের ক্ষেত্র। এখানে তিনি অরূপ চৌধুরী, কৃষ্ণা মিশ্র ভট্টাচার্য, অগ্নি রায় সহ আরও অনেক সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে আসেন। এই সংযোগগুলি তাঁর সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও প্রসারিত করে এবং নতুন সৃষ্টির অনুপ্রেরণা জোগায়।

সাহিত্যচর্চার ধারাবাহিকতা: ঘুমঘর ও আকাশচুম্বন

'দিল্লী হাটার্স ' গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হওয়ার পর পীযূষকান্তি বিশ্বাসের সাহিত্যচর্চা আরও গতি পায়। এই গোষ্ঠীর উদ্যোগেই তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পথ সুগম হয়। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে 'দিল্লী হাটার্স ' থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বই 'ঘুমঘর'। বইটির প্রকাশক ছিলেন গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য দিলীপ ফৌজদার। এই বইটি দিল্লির সাহিত্য মহলে যথেষ্ট সমাদৃত হয় এবং কবি হিসেবে তাঁর পরিচিতিকে আরও দৃঢ় করে।

এর ঠিক দু'বছরের মাথায়, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, তিনি পৌঁছে যান আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকে। এবার তাঁর কবিতার বই প্রকাশিত হয় পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম পরিচিত প্রকাশনা সংস্থা 'অভিযান পাবলিশার্স' থেকে। বইটির নাম 'আকাশচুম্বন'। কলকাতা থেকে বই প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ লাভ করেন। 'আকাশচুম্বন' কাব্যগ্রন্থটি তাঁর কবি জীবনের এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। পরপর তিনটি কাব্যগ্রন্থ ('বাধা নই রক্ত', 'ঘুমঘর', 'আকাশচুম্বন') প্রকাশের মাধ্যমে তিনি দিল্লির বাংলা কবিতার জগতে নিজের একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হন। তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় প্রেম, প্রকৃতি, ব্যক্তিগত অনুভূতি, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং এক প্রবাসী মনের শিকড়ের প্রতি টান।

সম্পাদনার জগতে প্রবেশ: কথাঞ্জলী থেকে দেহলিজ

পীযূষকান্তি বিশ্বাস কেবল একজন কবি হিসেবেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, সম্পাদনার ক্ষেত্রেও তিনি তাঁর দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর সম্পাদনা যাত্রা শুরু হয়েছিল 'কথাঞ্জলী’ পত্রিকার সাথে যুক্ত থাকার সময় থেকেই, যেখানে তিনি বিভিন্ন ভূমিকায় ছিলেন (২০০২-২০১২)।

এরপর ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি পালাম কলোনি থেকে প্রকাশিত 'প্রতিভা পথিকৃৎ' নামক একটি পত্রিকার সাথে যুক্ত হন। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন গোপাল চন্দ্র পাল। পীযূষকান্তি বিশ্বাস পত্রিকাটির পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং এর মানোন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।

২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে অল্প সময়ের জন্য তিনি দিল্লি এনসিআর অঞ্চলের অন্যতম প্রধান বাংলা পত্রিকা 'দিগঙ্গন'-এর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হিসেবেও কাজ করেন। 'দিগঙ্গন' বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় এবং দিল্লির বাঙালি সমাজে এর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।

তাঁর সম্পাদনা জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয় 'শূন্যকাল' পত্রিকার সাথে। 'শূন্যকাল' ছিল একটি ওয়েব ম্যাগাজিন, যা শুরু করেছিলেন এবং সম্পাদনা করতেন দীপঙ্কর দত্ত। ২০১৬ সালে দীপঙ্কর দত্তের আকস্মিক প্রয়াণের পর পত্রিকাটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। সেই কঠিন সময়ে পীযূষকান্তি বিশ্বাস এগিয়ে আসেন এবং পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে 'শূন্যকাল'-এর সম্পাদনা করেন এবং প্রয়াত সম্পাদকের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান। এটি ছিল তাঁর সাহিত্যিক দায়বদ্ধতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

'শূন্যকাল'-এর সম্পাদনার অভিজ্ঞতা তাঁকে একটি নতুন উদ্যোগ নিতে অনুপ্রাণিত করে। ২০১৮ সালে তিনি নিজেই একটি নতুন ওয়েব ম্যাগাজিন শুরু করেন, যার নাম দেন 'দেহলিজ'। 'দেহলিজ' নামটি দিল্লির প্রতি ইঙ্গিতবাহী এবং একইসাথে এটি সাহিত্য জগতের প্রবেশদ্বারকেও বোঝায়। এই ওয়েব ম্যাগাজিনটি অল্প সময়ের মধ্যেই পাঠক ও লেখকদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। পীযূষকান্তি বিশ্বাস অত্যন্ত যত্ন ও মুন্সিয়ানার সাথে 'দেহলিজ'-এর সম্পাদনা করে চলেছেন। পরবর্তীকালে 'দেহলিজ'-এর নির্বাচিত লেখাগুলি নিয়ে গ্রন্থাকারে 'নির্বাচিত দেহলিজ' নামে মুদ্রিত সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানেও তিনি 'দেহলিজ'-এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন এবং এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি দিল্লি তথা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি লেখক-কবিদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছেন। 'দেহলিজ' (https://dehlij.blogspot.com) তাঁর সম্পাদনা জীবনের এক সার্থক সৃষ্টি।

পেশাগত জীবন: বায়ুসেনা থেকে আন্তর্জাতিক আইটি জগৎ ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন

পীযূষকান্তি বিশ্বাসের জীবন দুটি সমান্তরাল পথে প্রবাহিত – একটি সাহিত্যের স্নিগ্ধ জগৎ, অন্যটি প্রযুক্তির যুক্তিনির্ভর কর্মক্ষেত্র। ভারতীয় বায়ুসেনায় কর্মজীবন শুরু করার পর তিনি সেখানে প্রযুক্তিগত বিভিন্ন দায়িত্ব সামলেছেন। এয়ার ডিফেন্স অপারেশন, কার্টোগ্রাফি থেকে শুরু করে EDP সেলে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট – বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি তাঁর দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

বায়ুসেনা থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি কর্পোরেট জগতে প্রবেশ করেন। তাঁর প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা তাঁকে আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রযুক্তি (IT) শিল্পে এক উজ্জ্বল কেরিয়ার গড়তে সাহায্য করে। তিনি প্রথমে 'ইনফোগেইন' (Infogain) নামক একটি বহুজাতিক আইটি কোম্পানিতে যোগদান করেন। এই কোম্পানির হয়েই তিনি ২০০৭ সালে অফিশিয়াল ট্যুরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে যান, যা তাঁকে আন্তর্জাতিক কর্মপরিবেশের সাথে পরিচিত হওয়ার প্রথম সুযোগ করে দেয়।

এরপর তিনি যোগ দেন 'পেরোট সিস্টেমস'-এ (Perot Systems)। এই কোম্পানির হয়ে ২০০৮ সালে তিনি অফিশিয়াল ট্যুরে লন্ডনে যান। এই আন্তর্জাতিক ভ্রমণগুলি তাঁর পেশাগত অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকেও প্রসারিত করে।

পরবর্তীকালে তিনি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্রযুক্তি সংস্থা 'ডেল'-এ (Dell) যোগদান করেন। ডেল-এর হয়ে তিনি ২০১২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের রাউন্ড রকে যান কোম্পানির জন্য ক্লাউড সিস্টেম তৈরির গুরুত্বপূর্ণ প্রোজেক্টে কাজ করার জন্য। ক্লাউড কম্পিউটিং-এর মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তাঁর দক্ষতা বাড়তে থাকে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে ফিরে আসার পর তিনি যোগ দেন আর একটি বিখ্যাত আমেরিকান বহুজাতিক সংস্থা 'আইবিএম'-এ (IBM)। বর্তমানে তিনি আইবিএম-এ ক্লাউড আর্কিটেক্ট হিসেবে কর্মরত। এই উচ্চ পদে আসীন থেকে তিনি প্রযুক্তির জগতে নিরন্তর অবদান রেখে চলেছেন।

তাঁর প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের এক অসামান্য নিদর্শন হল তাঁর নামে থাকা তিনটি আমেরিকান পেটেন্ট (USPTO)। নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য এই পেটেন্টগুলি লাভ করা নিঃসন্দেহে এক বিরাট কৃতিত্ব এবং মানবতার কল্যাণে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদানের সাক্ষ্য বহন করে। এছাড়াও তিনি দশটি টেকনিক্যাল পাবলিকেশন ও পেপার লিখেছেন, যা প্রযুক্তি জগতে তাঁর জ্ঞান ও গবেষণার গভীরতার পরিচায়ক। পেশাগত জীবনে তাঁর এই সাফল্য তাঁকে গুরুগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে বক্তৃতা দেওয়ার সম্মানও এনে দিয়েছে।

প্রযুক্তি ও সাহিত্যের মেলবন্ধন: এক বিরল সমন্বয়

পীযূষকান্তি বিশ্বাসের অনন্যতা এখানেই যে, তিনি প্রযুক্তি ও সাহিত্য – এই দুই আপাতভিন্ন জগৎকে অনায়াসে মিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি কেবল একজন প্রযুক্তিবিদ বা কেবল একজন সাহিত্যিক নন, তিনি এই দুইয়ের সংযোগকারী এক সেতু। তাঁর প্রযুক্তিগত জ্ঞানকে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সেবায় নিপুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন।

তিনি প্রয়াত দীপঙ্কর দত্তকে 'শূন্যকাল' ওয়েব ম্যাগাজিনটি প্রযুক্তিগতভাবে তৈরি করতে সাহায্য করেছিলেন। নিজের ওয়েব ম্যাগাজিন 'দেহলিজ'-এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নেও তাঁর প্রযুক্তিগত দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য তাঁর এক উল্লেখযোগ্য অবদান হল 'লিপিকা' (Lipika) সফটওয়্যার তৈরি করা। এই সফটওয়্যারটি ইংরেজি কিবোর্ড ব্যবহার করে সহজেই ইউনিকোড ফরম্যাটে বাংলা টাইপ করার সুবিধা প্রদান করে। বাংলা লেখার ক্ষেত্রে এটি একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও ব্যবহারবান্ধব টুল।

এছাড়াও তিনি বাংলা ভাষার জন্য 'কম্পিউটার এইডেড পোয়েট্রি' (Computer Aided Poetry) সফটওয়্যার তৈরির মতো অভিনব উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রযুক্তির সাহায্যে বাংলা কবিতার গঠন, ছন্দ, মিল ইত্যাদি বিশ্লেষণ বা সৃষ্টিতে সহায়তা করার এই প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। এটি প্রমাণ করে যে, প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগ সাহিত্যের বিকাশেও সহায়ক হতে পারে। তাঁর এই উদ্যোগগুলি বাংলা সাহিত্যকে ডিজিটাল যুগে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সাহিত্যিক পদচারণা ও স্বীকৃতি

পীযূষকান্তি বিশ্বাসের সাহিত্য প্রতিভা কেবল দিল্লির গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা ছড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক স্তরেও। তিনি একজন কবি হিসেবে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (SAARC) আয়োজিত একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্য উৎসবে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ লাভ করেন। এটি ছিল তাঁর সাহিত্যিক জীবনের এক বড় স্বীকৃতি।

এছাড়াও দিল্লির প্রগতি ময়দানে আয়োজিত বিশ্বপুস্তক মেলা (World Book Fair) এবং কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশগ্রহণকারী কবিদের তালিকায় তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা তাঁর কবি পরিচিতিকে আর সুখ্যাতি দিয়েছে।

কেবলমাত্র পেশাগত কাজেই নয়, সাহিত্যের টানেও তিনি আন্তর্জাতিক ভ্রমণ করেছেন। ২০২৩ সালে তিনি বাংলাদেশ সফর করেন। চট্টগ্রামের একটি সাহিত্য উৎসবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি ওপার বাংলার সাহিত্যিক ও পাঠকদের সাথে ভাব বিনিময়ের সুযোগ লাভ করেন। এই সফর দুই বাংলার সাহিত্যিক সেতুবন্ধনকে আরও মজবুত করেছে।

ব্যক্তিগত জীবন ও পারিবারিক পরিমণ্ডল

পীযূষকান্তি বিশ্বাস এক বর্ণময় কর্মজীবন ও সাহিত্য জীবনের অধিকারী হলেও তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ভিত্তি অত্যন্ত দৃঢ়। তাঁর পিতা জ্ঞানেন্দ্রনাথ বিশ্বাস ও মাতা করুণাময়ী বিশ্বাসের স্নেহছায়ায় তাঁর বেড়ে ওঠা। তাঁর সহধর্মিণী বিউটি বিশ্বাস তাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, বিশেষ করে তাঁর সাহিত্যচর্চায়, এক নীরব কিন্তু দৃঢ় সমর্থনের উৎস। তাঁদের একমাত্র পুত্র ঋজুস্মিত বিশ্বাসকে নিয়ে তাঁদের সুখী পরিবার। দিল্লির মহাবীর এনক্লেভের বাঙালি কলোনিতে তাঁদের শান্তির নীড়। পরিবার তাঁর জীবনে অনুপ্রেরণা ও মানসিক আশ্রয়ের এক নির্ভরযোগ্য কেন্দ্র।

পি-৩: তেত্রিশ ফুটা রোডের আড্ডা থেকে আন্তর্জাতিক সাহিত্য

নতুন দিল্লির যান্ত্রিক কোলাহলের গভীরে, যেখানে ব্যক্তিমানুষের নিজস্ব জগৎ প্রায়শই কংক্রিটের অরণ্যে হারিয়ে যায়, সেখানে কিছু ব্যতিক্রমী উদ্যোগ প্রাণের মরূদ্যান তৈরি করে। মহাবীর এনক্লেভ অঞ্চলের বুকে এমনই এক সৃষ্টিশীল ও প্রাণবন্ত প্রয়াসের নাম 'পি-৩'। এটি কোনো গতানুগতিক সাহিত্য সংগঠন নয়, বরং তিন বন্ধুর – প্রাণজি বসাক, প্রণব দত্ত এবং পীযূষকান্তি বিশ্বাস – একাত্ম সাহিত্যিক অভিযাত্রা। নামের আদ্যক্ষর 'প' বা ইংরেজি 'P'-এর এই সমাহার কেবল তিনটি নামের পরিচিতি বহন করে না, এ যেন রাজধানীর বুকে বাংলা সাহিত্যচর্চার প্রতি তাঁদের সম্মিলিত 'প্রাণ'-শক্তির এক জীবন্ত প্রতীক। এই ত্রয়ী সঙ্গমের বিশেষত্ব শুধু তাঁদের সাহিত্যপ্রীতির মিলনে নয়, তাঁদের ভৌগোলিক নৈকট্যেও। একই পাড়া, মহাবীর এনক্লেভে তাঁদের বাস। এই প্রতিবেশীসুলভ অন্তরঙ্গতা তাঁদের সাহিত্যিক সংযোগকে দিয়েছে এক বিরল স্বতঃস্ফূর্ততা, যা এই বিচ্ছিন্নতার যুগে এক উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি।

'পি-৩'-এর প্রাণভোমরা হল তাঁদের নিয়মিত, প্রায় রোজকার সাহিত্য আড্ডা। এই আড্ডার ঠিকানা কোনো অভিজাত প্রেক্ষাগৃহ বা নির্দিষ্ট কার্যালয় নয়, বরং মহাবীর এনক্লেভের ধমনীর মতো বয়ে চলা এক পরিচিত রাস্তা – 'তেত্রিশ ফুটা রোড'। এই নামটিই যেন আড্ডাটির অনানুষ্ঠানিক, মাটির কাছাকাছি থাকা চরিত্রটিকে তুলে ধরে। ব্যস্ত রাস্তার ধারে, হয়তো কোনো চায়ের দোকানে চুমুক দিতে দিতে, বা পথের পাশে বসেই জমে ওঠে তাঁদের সাহিত্যিক আলাপন। পাড়ার কাছাকাছি হওয়ায় সময়ের কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। কর্মব্যস্ত দিনের শেষে, অলস দুপুরে বা শান্ত সন্ধ্যায় – যখনই তিন বন্ধুর সময় মেলে, তেত্রিশ ফুটা রোড মুখরিত হয় তাঁদের সৃষ্টিশীল গুঞ্জনে। এই আড্ডা তাঁদের কাছে শ্বাস নেওয়ার মতো, সাহিত্যিক অক্সিজেন গ্রহণের মতো। এখানে আলোচনা হয় সদ্য লেখা কবিতা বা গল্প নিয়ে, চলে গঠনমূলক সমালোচনা, উঠে আসে দেশ-বিদেশের সাহিত্যের খবর, আলোচিত হয় নতুন বই, সাহিত্য তত্ত্ব কিংবা অনুবাদের কলাকৌশল। পীযূষকান্তি বিশ্বাস, যিনি একাধারে কবি, সম্পাদক ও প্রযুক্তিবিদ, তাঁর ভিন্নধর্মী ভাবনা; প্রাণজি বসাকের অভিজ্ঞতা ও প্রণব দত্তের বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা – এই ত্রিবেণী সঙ্গম আড্ডাটিকে এক অনন্য মাত্রা দেয়। এখানে পাণ্ডিত্যের ভার নেই, আছে বন্ধুত্বের উষ্ণতা আর সাহিত্যের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা।

'পি-৩'-এর সদস্যদের মধ্যেকার এই বোঝাপড়া ও অভিন্ন লক্ষ্যের একটি সুন্দর দৃশ্যমান প্রতীক হল তাঁদের একই রঙের পাঞ্জাবি পরিধান। যখন তাঁরা একসাথে কোনো সাহিত্য অনুষ্ঠানে যান বা কোনো অতিথির সাথে মিলিত হন, তখন এই একই রঙের পোশাক তাঁদের গোষ্ঠীবদ্ধতার এক স্নিগ্ধ পরিচয় তুলে ধরে। এটি কেবল বাহ্যিক আবরণ নয়, এ যেন তাঁদের ভেতরের ঐক্য ও সাহিত্যিক সংহতির এক প্রতীকী বহিঃপ্রকাশ, যা তাঁদের স্বতন্ত্র সত্তার পাশাপাশি সম্মিলিত সত্তাকেও মূর্ত করে তোলে।

তাঁদের সাহিত্যিক অভিযাত্রা কেবল দিল্লির গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেনি, তা ছড়িয়ে পড়েছে সীমানা পেরিয়ে। অতি সম্প্রতি তাঁরা একটি সাহিত্য সফরে বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছেন। এই সফর নিঃসন্দেহে তাঁদের অভিজ্ঞতাকে আরও প্রসারিত করেছে এবং ওপার বাংলার সাহিত্যিক পরিমণ্ডলের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের সুযোগ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, তাঁরা উত্তরাখণ্ডের শক্তিফার্মেও গিয়েছেন। সেখানকার প্রবাসী বাঙালিদের উৎসাহে আয়োজিত একটি সাহিত্য সভায় তাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন, যা প্রমাণ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা কেবল পরিচিত গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়, যেখানেই বাঙালিরা রয়েছে, সেখানেই তাঁরা সংযোগ স্থাপনে আগ্রহী। এই উদ্যোগগুলি 'পি-৩'-কে একটি নিছক আড্ডার গোষ্ঠী থেকে এক সক্রিয় সাহিত্য মিশনে উন্নীত করেছে।

'পি-৩'-এর শিকড় প্রোথিত তাঁদের নিজেদের এলাকা, মহাবীর এনক্লেভে। এই অঞ্চলের সাহিত্যিক পরিবেশকে আরও উর্বর করে তোলার জন্য তাঁরা এক বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হল বছরে একবার দিল্লি শহরের বিভিন্ন প্রান্তের সাহিত্যিকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মহাবীর এনক্লেভে একটি বড় সাহিত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। এই অনুষ্ঠানের মূল লক্ষ্য হল স্থানীয় প্রতিভা এবং সামগ্রিক দিল্লি অঞ্চলের সাহিত্যিকদের মধ্যে একটি মেলবন্ধন ঘটানো এবং মহাবীর এনক্লেভকে দিল্লির বাংলা সাহিত্যচর্চার মানচিত্রে আরও উজ্জ্বলভাবে প্রতিষ্ঠা করা। এই বাৎসরিক আয়োজনটি এখন এলাকার সাহিত্যপ্রেমী মানুষদের কাছে একটি প্রতীক্ষিত অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে এবং এটি 'পি-৩'-এর সাংগঠনিক দক্ষতা ও কমিউনিটি সম্পৃক্ততার এক চমৎকার উদাহরণ।

উপসংহারে বলা যায়, 'পি-৩' (প্রাণজি বসাক, প্রণব দত্ত, পীযূষকান্তি বিশ্বাস) দিল্লির মতো এক বিশাল ও কর্মব্যস্ত মহানগরে মহাবীর এনক্লেভে বৃহত্তর পরিসরে সাহিত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন – এই সবকিছু মিলিয়ে 'পি-৩' একটি বহুমাত্রিক চরিত্র লাভ করেছে। তাঁরা প্রমাণ করেছেন, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরেও, সদিচ্ছা, বন্ধুত্ব ও সাহিত্যের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা থাকলে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর সাহিত্যিক আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব। তেত্রিশ ফুটা রোড কেবল একটি রাস্তার নাম নয়, এটি এখন দিল্লির বুকে বাংলা সাহিত্যের এক প্রাণবন্ত স্পন্দন কেন্দ্রের প্রতীক।

উপসংহার: এক বহুমাত্রিক প্রতিভার নিরন্তর যাত্রা

পীযূষকান্তি বিশ্বাস এক বিরল ব্যক্তিত্ব, যাঁর মধ্যে প্রযুক্তিবিদের যুক্তিনিষ্ঠ মনন এবং কবির সংবেদনশীল হৃদয়ের এক আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার গ্রাম্য পরিবেশ থেকে যাত্রা শুরু করে ভারতীয় বায়ুসেনার শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন, অতঃপর আন্তর্জাতিক কর্পোরেট জগতের শীর্ষস্থানে আরোহণ এবং একইসাথে বাংলা কবিতার জগতে নিজস্ব স্বাক্ষর রাখা – তাঁর জীবনযাত্রা এক বহুমাত্রিক উপাখ্যান।

সার্ক সাহিত্য উৎসব থেকে শুরু করে কলকাতা ও দিল্লি বইমেলা, এমনকি বাংলাদেশের সাহিত্য মঞ্চেও তাঁর উপস্থিতি তাঁর সাহিত্যিক পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ। গুরুগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে তাঁর সম্মাননা তাঁর পেশাগত শ্রেষ্ঠত্বের দ্যোতক।

পীযূষকান্তি বিশ্বাস প্রমাণ করেছেন যে, পেশা ও নেশা, প্রযুক্তি ও শিল্প, যুক্তি ও আবেগ একসাথে চলতে পারে এবং একে অপরকে সমৃদ্ধ করতে পারে। তাঁর জীবন ও কর্ম প্রবাসী বাঙালি তো বটেই, সকল সাহিত্য ও প্রযুক্তিপ্রেমী মানুষের কাছে এক অনুপ্রেরণা। নতুন দিল্লির বুকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে, একজন সংবেদনশীল কবি ও দক্ষ সম্পাদক হিসেবে এবং একজন সফল প্রযুক্তিবিদ হিসেবে তাঁর যাত্রা আজও অব্যাহত। আশা করা যায়, আগামী দিনে তাঁর কলম ও মেধা বাংলা সাহিত্য এবং প্রযুক্তি জগৎকে আরও অনেক নতুন দিশা দেখাবে। তাঁর এই দ্বৈত সত্তার নিরন্তর পথচলা সমৃদ্ধ করুক আমাদের সাহিত্য ও জীবনকে।